বিনিয়োগ আকৃষ্টে ব্যাপক করছাড় - Amader Bangladesh

আব্দুল্লাহ কাফি : করোনায় বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাপক করছাড় দিচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে একই বিলাসী পণ্যে কর বাড়ানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রপ্তানি নেই। পুরো পোশাক খাত বিপর্যস্ত। এ সময় উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাবনা আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল।

প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব খাতে করছাড় দেওয়া হচ্ছে

করপোরেট ট্যাক্স কমছে : বিনিয়োগ আকৃষ্টে করপোরেট ট্যাক্স কমানো হচ্ছে। দীর্ঘ ৫ বছর পর করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৩২ শতাংশ করা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করপোরেট ট্যাক্স আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়। তবে অপরিবর্তিত থাকবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা, মোবাইল অপারেট ও সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের করপোরেট ট্যাক্স হার।

টার্নওভার ট্যাক্স কমছে : ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে বাজেটে টার্নওভার ট্যাক্সের হার কমানো হচ্ছে। এটি ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। ভ্যাট অব্যাহতির সীমা আগের মতোই ৫০ লাখ টাকা এবং টার্নওভারের ঊর্ধ্বসীমা ৩ কোটি টাকা থাকছে। তবে সব শ্রেণির ব্যবসায় নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ : ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বাজেটে। এ জন্য আয়কর অধ্যাদেশের নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধারা অনুযায়ী, আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরকারি বন্ড ও ডিভেঞ্চারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, ৩ বছরের জন্য এই বিনিয়োগ করতে হবে। এর আগে বিনিয়োগের টাকা উত্তোলন করলে করদাতাকে সাধারণ হারে কর পরিশোধ করতে হবে।

করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে : দীর্ঘ ৫ বছর পর ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। মহিলা, প্রতিবন্ধী ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যাহতির সীমাও আনুপাতিক হারে বাড়ছে। অন্যদিকে ব্যক্তিশ্রেণির করহারও কমানো হচ্ছে। ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে করের বোঝা কমবে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে ন্যূনতম করহার।

অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট বৈধের সুযোগ : আয়কর রিটার্নে দেখানো নেই- এমন অপ্রদর্শিত বা কালো টাকায় কেনা জমি-ফ্ল্যাট বৈধ এবং নগদ টাকা, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র দেখানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য আগ্রহীদের এলাকাভেদে বর্গমিটার প্রতি নির্দিষ্ট অঙ্কের কর দিতে হবে। অভিজাত এলাকায় জমি-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বেশি হারে কর দিতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত নগদ টাকা, ব্যাংক ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র রিটার্নে দেখানো যাবে। এ জন্য মোট অঙ্কের ১০ শতাংশ কর দিতে হবে।

কালো টাকা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের পরিসর বাড়ছে : আগে শুধু কালো টাকা বিনিয়োগ করে আবাসিক ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ ছিল। বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ বিবিবিবিবি ধারা সংশোধন করে কমার্শিয়ালসহ সব ধরনের ফ্লোর কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বর্গমিটার প্রতি নির্দিষ্ট অঙ্কে কর পরিশোধ করতে হবে।

কর অবকাশের আওতা বাড়ছে : বাজেটে নতুন শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আর্টিফিসিয়াল ফাইবার প্রোডাকশন, ন্যানো টেকনোলজি বেইজড প্রোডাক্ট, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, অটোমোবাইল পার্টস, রোবোটিক ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং, ইলেকট্রিক্যাল ট্রান্সফরমার প্রোডাকশন, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড সার্ভিস শিল্পকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আগে ২৬টি শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হয়। অন্যদিকে বাজেটে রাজস্ব আয়ের বিশাল লক্ষ্য অর্জনে বিলাসী পণ্যে বাড়তি করারোপ করা হচ্ছে।

গার্মেন্টসের উৎসে কর বাড়ছে : বিপর্যস্ত তৈরি পোশাক খাতের উৎসে করও বাড়ানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছর রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পকে মোট রপ্তানি আয়ের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হতো। আগামী বাজেটে সেটি বাড়িয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে পোশাক খাতের করপোরেট কর আগের অবস্থানেই রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়ছে : সিসিভেদে ব্যক্তিগত গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে অগ্রিম আয়কর বাড়ানো হচ্ছে। ১৫০০ সিসির কম ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির অগ্রিম কর ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার, ১৫০০ থেকে ২০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির কর ৩০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ হাজার, ২৫০০ থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি ৭৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ১ লাখ টাকা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার, ৩৫০০ সিসির বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা এবং মাইক্রোবাসের অগ্রিম কর ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করা হচ্ছে।

বড় লোকের বেশি কর : বড় লোকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের আবগারি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। তবে ছোট সঞ্চয়কারী বা ব্যাংক আমানতধারীদের কর আগের মতোই থাকছে। যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতি বছরে ৫ কোটি টাকার বেশি, সেসব অ্যাকাউন্টের আবগারি শুল্ক ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়ানো হচ্ছে।

ভার্চুয়াল বিজ্ঞাপনে খরচ বাড়বে : ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি) বিজ্ঞাপনের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। এবারের বাজেটে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করা হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের সময় ব্যাংকে ভ্যাট ও উৎসে কর কেটে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

ধূমপায়ীদের বাড়তি কর দিতে হবে : রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রথাগতভাবে এবার সিগারেটের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে সিগারেট ফুঁকতে ধূমপায়ীদের বাড়তি কর দিতে হবে। আর সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব পাবে।

মোবাইল খরচ বাড়ছে : গ্রাহকদের মোবাইল খরচ বাড়ছে। কারণ মোবাইলে সব ধরনের সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ১০০ টাকা রিচার্জ করে ৭৮ টাকা ২৭ পয়সার সেবা পাওয়া যায়। বাকি ২২ টাকা ৭২ পয়সা ট্যাক্স-ভ্যাট হিসেবে সরকার পায়। এবারের বাজেটে সম্পূরক বাড়ানোর কারণে গ্রাহক ৭৩ টাকার সেবা পাবেন। বাকি ২৭ টাকা সরকার কর হিসেবে পাবে।

মিথ্যা ঘোষণা ধরা পড়লে জরিমানা : আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা (১৬ এইচ) যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধারা অনুযায়ী, আয়কর রিটার্ন পর্যালোচনা করে পণ্য আমদানিতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আন্ডার ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে গোপনকৃত বা পাচারকৃত অর্থের ৫০ ভাগ জরিমানা আদায় করা হবে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, যে সমস্যার কারণে উৎসে কর কমানোর হলো তার চেয়েও বর্তমানে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে উৎসে কর বাড়ানোর প্রস্তাব কতটা যৌক্তিক তা আমাদের বোধগম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা করি।

About Author