অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকার ডলার পাচার করছে এম টি ফি (MTFE) - Amader Bangladesh

সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হওয়ার ঘটনা দেশে অনেক ঘটেছে। অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ হলো ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে নতুন একটি চক্র এর চেয়ে ভয়াবহ রূপে প্রতারণা শুরু করেছে। 

অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এমটিএফই নামের একটি অনলাইন ট্রেডিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। কোম্পানীটির পুরো নাম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ। কোম্পানীটি কানাডা থেকে পরিচালনা করা হয় বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু কোম্পানীর বিষয়ে গুগলে সার্চ করলেই দেখা যায় এই কোম্পানীর নামে নাইজেরিয়া, ঘানাসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রতারণার শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

তাছাড়া, কোম্পানীর কর্মকর্তা সেজে যারা মানুষকে বিনিয়োগের লোভনীয় অফার দিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রায় সকলেই পূর্বে এমএলএম ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলো। তারা পূর্বেও মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ডেসটিনি ও যুবকের মাধ্যমে। এখন তারাই শুধু নাম ও রূপ পরিবর্তন করে পুনরায় মানুষের টাকা হানিয়ে নেওয়ার  ফন্দি এটেছে।

এমটিএফই ব্যবসায় প্রতারিত হয়েছেন এমন অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, MTFE একটি অনলাইন প্লাট ফর্ম। যাতে অনেক লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে থাকে। লোভনীয় অফারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ৬৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে প্রতি মাসে ২৪ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। তাছাড়া আরও যত মানুষকে রেফারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করাবেন এর উপরও মোটা অংকের কমিশনের লোভ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু কিছু দিন টাকা বিনিয়োগ করার পর টাকা তুলার সময় হয়ে এলে দেখা যায় সফটওয়্যার আপডেট চলছে, এখন সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে, ট্রানজেকশন করা যাচ্ছে না ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা দেখায়। পরে দেখা যায় অটো ট্রেড নামক একটি অপশনের কারণে পুরো ব্যালেন্স শুন্য হয়ে যায়।  এমটিএফই’র প্রতারণার বিষয়ে নিউজ রিলসের অনুসন্ধানে উঠে আসে এসব তথ্য। 

অনুসন্ধানে জানা যায়,  MTFE এর ওয়েব সাইটে কোন প্রকার সোসাল মিডিয়ার লিংক নাই। নেই প্রতিষ্ঠানের মালিক বা  কর্মকর্তাদের  কোন প্রোফাইল । সব থেকে বড় বিষয়, এসমস্ত প্রতিষ্ঠানের সরকারী কোন অনুমোদন নাই। জানা যায়, বাংলাদেশে MTFE পরিচালনার জন্য ৪৯ জন সিইও মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। যারা সিইও হওয়ার জন্য কমপক্ষে ১০০ জনকে বিনিয়োগ করিয়েছেন। এক এক জন সিইও প্রায় দেড় কোটি টাকা করে বিনিয়োগ দেখাতে পারলে তিনি সিইও হিসেবে কোম্পানীতে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। কোম্পানী থেকে প্রতি সিইও কে ৩ লক্ষ টাকা বেতন দেয়া হয়। তবে কোনো সিইও এখন পর্যন্ত ৩ লক্ষ টাকা বেতন কোম্পানী থেকে তুলতে পারে নি। এছাড়া প্রতি সিইও কে একটি অফিস নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু অফিসের ভাড়া দিতে পেরে প্রায় প্রতিটি অফিসই ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর পল্টন, মগবাজার, মালিবাগ, মতিঝিলের মতো জায়গায় তারা অফিস নিয়ে মাত্র ২ থেকে ৩ মাস অফিস করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে। আবার অনেক অফিসে বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরত চেয়ে ভাংচুর করতে আসার কারণেও অনেক সিইও পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিইও জানায়, ‘আমি এই অ্যাপ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু আমার মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এর অভিজ্ঞতা আছে জেনে এমটিএফএ’র একজন আমাকে এই অ্যাপসের মাধ্যমে কাজ করার অফার দিলে। অফারটি বেশ ভালো লাগায়, আমি ২ মাসের মধ্যে ১১২ জনকে প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করিয়েছি। প্রথম কয়েকদিন বিনিয়োগকারীদের একাউন্টে কিছু কিছু করে ডলার জমা হতে থাকে, অটো ট্রেড করার মাধ্যমে সম্পন্ন হতো।  এ পদ্ধতিতে ট্রেড করার কয়েকদিনের মধ্যেই অনেকের ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। এতে আমি আতংকিত হয়ে আমার সিইও কে জানালে তিনি বলে এতে কোনো সমস্যা নেই, পরে সমাধান করে দিবো। কিন্তু এরপর থেকেই তিনি আমার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। কিছু মানুষকে টাকা তুলে ফেলতে বলি, ততদিনের অনেকের টাকাই শূন্যতে চলে আসে। এখন এই বোঝা নিয়ে আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

নাহিদ হাসান নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘চলতি বছরের শুরুতে এই অ্যাপের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথমে কিছু টাকা লাভ হয়েছিল। তখন আমরা ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করতাম। টিম লিডার গোলাম মাওলা টিটু হোয়টসঅ্যাপ গ্রুপে পরামর্শ দেন অটো ট্রেড করার জন্য। এ পদ্ধতিতে ট্রেড করে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। আমি মনে করছি, এটা তাদের একটি পরিকল্পিত ফাঁদ ছিল। আমার প্রায় তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এখন পরিবারের চাপে আছি। টাকার কোনো হিসাব দিতে পারছি না।’

সাইমন সরকার নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘টিম লিডারদের কথা শুনে বিনিয়োগ করেছিলাম। ৫০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করার পর রাতারাতি ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। অ্যাপের সঙ্গে জড়িত প্রতারকচক্রকে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ভার্চুয়াল সম্পদ বা মুদ্রার বিনিময়, স্থানান্তর বা ট্রেডে  নিষিদ্ধ করেছে । নির্দেশনা অমান্য করে কেউ এ ধরনের লেনদেন করলে, তা হবে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধ করলে হতে পারে ৭ বছরের জেল বা আর্থিক জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির দেশে কোনো বৈধতা নেই, এটিতে উচ্চমাত্রায় ঝুঁকি আছে। বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কে সৃষ্টি করেছে তা কেউ জানে না, এটির কোনো মালিকানা নেই কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো সাপোর্ট নেই। এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে যারা প্রতারণা করছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা দরকার।

About Author